রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে দেশের স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন কার্যত চালাচ্ছেন আমলারা। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা ও উপজেলা পরিষদের মেয়র ও চেয়ারম্যানদের অপসারণ করে তাদের জায়গায় বসানো হয়েছে প্রশাসক।
সিটি করপোরেশনের স্বাভাবিক কার্যক্রম চলমান রাখতে কাজ করছেন সরকারের নিয়োগ করা প্রশাসকরা। কাউন্সিলর অফিস থেকে নাগরিক সেবার কার্যক্রম সরিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে আঞ্চলিক অফিসগুলোতে। এই রদবদলে অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে বিভিন্ন নাগরিক সেবা। থমকে গেছে উন্নয়নকাজও।
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, রাজধানীর উত্তরখান-দক্ষিণখানের রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ। অ্যাম্বুলেন্স যাওয়ার অবস্থাও নেই যে একজন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যাবে। পায়ে হেঁটে যাওয়াও মুশকিল। রাস্তা চওড়া ও ড্রেনের কাজের জন্য দীর্ঘদিন এই এলাকার কাজ চলছিল। কিন্তু স্থানীয়রা বলছেন, ৫ অগাস্টের পর থেকে ঠিকাদার পলাতক। ফলে কাজ বন্ধ। সারা দেশের চিত্র কমবেশি এরকমই।
ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা না হলেও দেড় হাজারের মতো চেয়ারম্যান পলাতক। ফলে সেসব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যত অচল। ইউনিয়ন পরিষদ ভবন খোলা থাকলেও অনেক জায়গায়ই চেয়ারম্যানরা পরিষদে যাচ্ছেন না। অনেক পরিষদে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। দেশের অনেক জায়গায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিলও করেছেন। সারা দেশের বেশ কিছু জেলায় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের পদত্যাগের দাবি জানিয়ে মিছিল কিংবা পরিষদ ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও হয়েছে।
সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে একটি অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানরা বলছেন, তাদের অপসারণ করলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে।
যেসব ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পলাতক নন,সেগুলোও যে খুব ভালো চলছে— তা বলার সুযোগ নেই। কারণ সবার মধ্যে একটা আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা কাজ করছে। পক্ষান্তেরে আমলারা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন চালাচ্ছেন তার চেয়ে বড় প্রশ্ন, কেন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো আমলারা চালাবেন?
সংবিধানের ৫৯ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের উপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’
তার মানে এখন স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানে যে অনির্বাচিত আমলাদের বসিয়ে দেয়া হলো, সেটি সংবিধানের এই বিধানের লঙ্ঘন। প্রশাসক নিয়োগের পক্ষে অনেক যুক্তিতর্ক এমনকি আইনি বিধিবিধান ও সংবিধানের ফাঁক-ফোকরের দোহাই দেয়া যাবে। কিন্তু দেশের অবস্থা যাই হোক না কেন, একসঙ্গে প্রায় সকল স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে সেখানে সরকারি কর্মচারীদের বসিয়ে দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়, কাঙ্ক্ষিত নয়, যৌক্তিকও নয়।
কেন গণহারে অপসারণ?
গত ৫ অগাস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলর এবং জেলা ও উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যানদের অপসারণ করা হয়।
প্রশ্ন হলো কেন তাদেরকে গণহারে অপসারণ করা হলো? তাদের অপরাধ কী? তাদের সবাই কি দুর্নীতিবাজ ছিলেন? তাদের সবাই কি বিনা ভোটে কিংবা জোর করে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন? নাকি তারা আওয়ামী লীগের আমলে নির্বাচিত হয়েছেন বলে সবাই আওয়ামী লীগের দোসর কিংবা ফ্যাসিস্ট? গণহারে সবাইকে ফ্যাসিস্ট, স্বৈরাচারের দোসর বা দালাল তকমা দেয়াও একধরনের ফ্যাসিজম—এটাও উপলব্ধি করা দরকার।
ধরা যাক, অপসারিত জনপ্রতিনিধিদের বিরাট অংশই আগের সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট এবং দুর্নীতিবাজ। কিন্তু তাদেরকে সরিয়ে যাদেরকে বসানো হলো তারা কি ধোয়া তুলসিপাতা? আমলারা দুর্নীতি করেন না? তারা ঘুষ খান না? জুলাই অভ্যুত্থানের দল হিসেবে আওয়ামী লীগের পরেই অভিযোগের তীর এবং মানুষের ক্ষোভ ছিল পুলিশের বিরুদ্ধে। তারপরেই আছে আমলাদের নাম। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যে নির্বাচনি ব্যবস্থাটি ধ্বংস করে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল এবং চতুর্থ মেয়াদেও ক্ষমতায় এসেছিল, সেখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা এই আমলাদের। সুতরাং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে সেখানে এই আমলাদেরই কেন বসানো হলো?
অপসারণের বিকল্প ছিল না?
জনপ্রতিনিদের এভাবে গণহারে অপসারণের বিকল্প কী হতে পারতো? বিকল্প হতে পারতো এই যে, স্থানীয় সরকারের সকল মেয়র ও চেয়ারম্যানদের ওপর সরকারের কড়া নজরদারি। সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর বাইরেও অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীদার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্যরা এই নজরদারিটি করতে পারতেন।
সেনাবাহিনী যেহেতু বিচারিক ক্ষমতাসহ এখনও মাঠে আছে, ফলে এটিও জনপ্রতিনিধিদের একধরনের চাপে রাখতো। তাছাড়া একটি বড় অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যেহেতু সরকারের পতন হলো এবং খোদ প্রধানমন্ত্রীকে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে হলো, ফলে কোনো জনপ্রতিনিধিই কোনো ধরনের অন্যায় বা দুর্নীতি করার সাহস করতেন না। বরং এই ভয় তাদরেকে অনেক বেশি গণমুখী করতে পারতো। পিঠ বাঁচানোর জন্য তারা নিজেদেরকে অনেক বেশি জনবান্ধব প্রমাণে ব্যস্ত থাকতেন।
কেবলমাত্র যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট হত্যা বা হত্যায় সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে, তারা ব্যতিরেকে বাকি সকল প্রতিনিধির জন্য সরকারের বিশেষ নিরাপত্তা বিধান করা উচিত ছিল। তার মধ্য দিয়ে বরং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় একধরনের জবাবহিদির সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারতো। এমনকি যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তাদেরও না সরিয়ে বরং স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখা যেতো।
এর মধ্য দিয়ে সরকার দুটি লক্ষ্য অর্জন করতে পারতো–
১. হঠাৎ করে স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিরাট শূন্যতা তৈরি হতো না এবং ২. আগের সরকারের আমলে নির্বাচিত বলে তারা প্রত্যেকে একটা চাপের মধ্যে থাকতেন এবং তার ফলে তারা অতীতের ভুলত্রুটি শুধরিয়ে নিজেদেরকে সত্যিকারের জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা করতেন।
কিন্তু সরকার সেই পথ অনুসরণ করেনি সম্ভবত পুরো দেশকে ‘আওয়ামী লীগমুক্ত’ করার অভিপ্রায়ে। তবে যে কারণেই গণহারে প্রায় সকল জনপ্রতিনিধিকে সরিয়ে দেয়া হলো, সেটি আখেরে কোনো ভালো ফল বয়ে আনছে না।
তাহলে উপায় কী?
এখন উপায় একটিই। সেটি হলো দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশাসকমুক্ত করা এবং সেই নির্বাচনটি হতে হবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই।
শুধুমাত্র মানুষের দৈনন্দিন যাবতীয় সেবা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সচল করাই নয়, বরং আরও কিছু কারণে জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়া উচিত। যেমন:
১. স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হবে না। ফলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে নির্দলীয় প্রার্থীদের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। দলীয় প্রার্থী হলেই তিনি খারাপ আর নির্দলীয় প্রার্থী মানেই ভালো— এই সরলীকরণের সুযোগ নেই এটা যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য যে, দলীয় মাস্তান এবং টাকাওয়ালা মাসলম্যানদের দাপটে নির্দলীয় বা দলীয় দাস নন এমন অনেক ভালো মানুষের ইচ্ছা থাকলেও তারা নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সাহস পান না। অনেক জায়গায় অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্থানীয় সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সমাজকর্মী, সংগঠক, ধর্মীয় নেতা যারা সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত এবং স্থানীয় মানুষেরা যাদেরকে জনপ্রতিনিধি হিসেবে দেখতে চান বা যারা জনপ্রতিনিধি হলে দুর্নীতিমুক্ত থেকে গণমুখী কাজ করবেন বলে বিশ্বাস করা হয়— সেরকম প্রার্থীদেরও নির্বাচনে রাজি করানো যায় না শুধুমাত্র দলীয় প্রার্থীদের দাপটের কারণে। কেননা স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা অন্য যে কোনো প্রার্থীর চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান হয়ে ওঠেন। তার একটি বড় কারণ স্থানীয় প্রশাসন তার পক্ষে থাকে বা থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু নির্দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে তখন এই দলীয় প্রার্থীদের দাপট কম থাকে। সেই সুযোগ অনেক ভালো মানুষের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। সুতরাং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করা যায়, তাহলে বিরাট সংখ্যক সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে নির্দলীয় তথা দলীয় আনুগত্য নেই এমন অনেক প্রার্থী জয়ী হবেন বলে ধারণা করা যায়— যাদের টাকা ও পেশিশক্তি না থাকলেও সমাজে ভালো মানুষ হিসেবে পরিচিত। যারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচিত না হওয়ার ফলে টাকা কামানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন না।
২. জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে রাজনৈতিক দলগুলো মাঠ পর্যায়ে নিজেদের ক্ষমতা জনসম্পৃক্ততারও একটা পরীক্ষা করতে পারবে। যেহেতু দেশে একটা বিরাট রাজনৈতিক অভ্যুত্থান হয়ে গেলো এবং শুধু ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগই নয় বরং এই ঘটনাটি যেহেতু সকল রাজনৈতিক দলের জন্যই একটি বিরাট শিক্ষা— অতএব স্থানীয় সরকার নির্বাচনে জনগণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তারা কী প্রতিশ্রুতি দেয় এবং জনগণ তাদের ওপর কতটা আস্থা রাখে, সেটি বোঝার জন্যও স্থানীয় নির্বাচনটি আগে হওয়া দরকার।
৩. স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব উঠে আসে। ফলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোন দল কেমন প্রার্থী দেবে এবং নেতৃত্বে আদৌ কোনো গুণগত পরিবর্তন আসবে কি না, তারও একটা মহড়া হয়ে যাবে।
সরকার কী ভাবছে?
গত ৮ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ইউরোপীয় বিনিয়োগ ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে আলোচনার সময় জানান, তার সরকার জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনেরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার একইসঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যেন স্থানীয় সরকার সত্যিই স্থানিক থাকে এবং একটি সরকার নিশ্চিত করা যায়।’
এর আগে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি চান স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো দ্রুত হোক। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত হলে দ্রুত স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেয়া সম্ভব হবে বলে তিনি মনে করেন।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে যে নাগরিক সেবার প্রয়োজন, সেগুলো সঠিকভাবে দেওয়া সম্ভব হয় না। নাগরিকরা অনেক ধরনের হয়রানির শিকার হয়, সময় ক্ষেপণ হয় এবং নাগরিক সেবা ঠিকমতো পায় না। এই চ্যালেঞ্জটা আমাদের এখন ফেস করতে হচ্ছে।’
গত ৬ জানুয়ারি সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদও বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন দ্রুত করার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর তাড়া থাকলেও ঢাকার বাইরের মানুষ স্থানীয় নির্বাচন করার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে। স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যেও একই রকম মতামত আসছে। কেননা মানুষ বলছে, ‘আমরা একটা শূন্যতার মধ্যে আছি। সেবা পাচ্ছি না। আমরা কার কাছে যাব বুঝতে পারছি না। যার ফলে এখন লোকাল নির্বাচনটা হয়ে যাওয়া উচিত।’
প্রশাসক থাকলে কী সমস্যা?
একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যে দলেরই হোন না কেন বা তিনি মানুষ হিসেবে যেমনই হোন না কেন, জনগণের সঙ্গে তার একটা সরাসরি যোগাযোগ থাকে। ভোটারের কাছে তাকে যেতে হয়। কমিউনিটির মানুষের সঙ্গে তার ওঠবস করতে হয়। কারণ তিনি ওই কমিউনিটিরই মানুষ। এসব কারণে মেয়র বা চেয়ারম্যান যে দলেরই হোন না কেন, তিনি একধরনের জবাবদিহির মধ্যে থাকেন। মানুষ সামনে না হলেও পেছনে তাকে গালমন্দ করতে পারে। তার নেতাকর্মী বা সাগরেদদের শুনিয়েও অনেক সময় মানুষ তাদের রাগ-ক্ষোভ ঝাড়ে যাতে তার কানে এটা পৌঁছায়।
কিন্তু যখন মেয়র ও চেয়ারম্যানদের চেয়ারে প্রশাসক বসে যান, তার সঙ্গে ওই কমিউনিটির মানুষের কোনো যোগসূত্র তৈরি হয় না। একজন চেয়ারম্যানের রুমে যত সহজে একজন সাধারণ মানুষ ঢুকে যেতে পারেন, স্যুটেট বুটেড একজন ডিসি, ইউএনও বা প্রশাসকের রুমে সেভাবে ঢুকে যেতে পারেন না। জনগণের সঙ্গে আমলাদের যে এই মানসিক দূরত্ব, সেটি বেশ পুরোনো এবং দূরত্ব ঘোচানোর কোনো উদ্যোগ কখনো চোখে পড়েনি। বরং এখনও কোনো কোনো ইউএনও বা সরকারের অন্য কোনো পর্যায়ের কর্মকর্তাকে ‘স্যার’ না বলায় তিনি ক্ষেপে গিয়েছেন, এরকম খবরও সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম নাম।
স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানে যাদেরকে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, তাদের কেউই ওই এলাকার নন। যার বাড়ি বগুড়ায়, তাকে প্রশাসক বানানো হয়েছে বরিশালে। যার বাড়ি বরিশাল তিনি হয়তো জামালপুর পৌরসভার প্রশাসক। অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মন ও পালস তিনি কতটা বোঝেন, বুঝতে পারেন বা বুঝতে চান— সেটি বিরাট প্রশ্ন। ফলে প্রশাসক মহোদয়রা সরকারের আর দশটি চাকরির মতোই স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভাবেন এবং সেই একই ফরম্যাটে এগুলো চালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু ডিসি অফিস আর পৌরসভা যে এক জিনিস নয়, সেটি বোঝা দরকার। ইউনিয়ন পরিষদের মতো একটি বিরাট জটিল জায়গা কতজন আমলার পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত জনপ্রনিধির বিকল্প নেই এবং দ্রুত নির্বাচন দিয়ে স্থানীয় সরকারপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশাসকমুক্ত করা জরুরি। সেইসঙ্গে জেলা পরিষদের মতো একটা অপ্রয়োজনীয় ও অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান আর রাখার প্রয়োজন আছে কি না— সেটিও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের ভেবে দেখা উচিত।
আগে হওয়ার অসুবিধা
জাতীয় সংসদের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আয়োজন করলে তাতে জাতীয় নির্বাচন আরও পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো বেশি সংস্কার না চাইলে আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। কিন্তু বেশি সংস্কার চাইলে আরও ছয় মাস সময় লাগবে।
প্রশ্ন হলো, সরকার যদি এখনও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে, তাহলে ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা পুনঃনির্ধারণসহ অন্যান্য কাজ শেষ করে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন কি আগামী জুনের আগে শুরু করা যাবে? আর এতগুলো নির্বাচন শুরুর পরে সেটি শেষ করতে কত মাস লাগবে? ডিসেম্বরের আগে কি স্থানীয় সরকার নির্বাচন শেষ করা যাবে? যদি তাই হয়, তাহলে জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে হবে? আগামী বছরের মাঝামাঝি? সেটি কি বিএনপিসহ দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার রাজনৈতিক দলগুলো মানবে? যদি না মানে তাহলে কি সরকারের সঙ্গে তাদের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি তৈরি হবে?
বস্তুত জাতীয় সংসদের চেয়েও স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনেক জটিল এবং সেখানে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ থাকে। নির্বাচন কমিশন এবং মাঠ প্রশাসনের প্রস্তুতিতে অনেক সময় লাগে। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতি নিতে হয়। তাছাড়া স্থানীয় সরকার নির্বাচন পুরোপুরি সংঘাতমুক্ত করা রীতিমতো অসম্ভব ব্যাপার। সুতরাং জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করলে তার মধ্য দিয়ে দেশের রাজনীতি নতুন করে সংঘাতময় হয়ে উঠবে কি না— সেই প্রশ্নও এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।