গত ১৬ বছর চট্টগ্রামের রাউজানে শত শত মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ-সদস্য এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীর হাতে। যেন দেশের ভেতরেই আরেকটি দেশ কায়েম করেছেন তিনি। গুম-খুন আর দখলের পাশাপাশি ১৬ বছর ধরে প্রবল প্রতাপের সঙ্গে রাউজানে মাটির নিচে গোপন ঘরে চালিয়ে আসতেন নির্যাতন। তার নিজস্ব ক্যাডার বাহিনীও ছিল।। তার কথা ছাড়া এখানে গাছের পাতাও যেন নড়ত না। এমন কথা স্বয়ং তিনিই বলতেন। ভিন্নমতের শত শত মানুষ হয়রানি-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শিকার হয়েছেন গুম-খুনের।
তার ভয়ে বছরের পর বছর এলাকাছাড়া ছিলেন বিএনপি, জামায়াত, মুনিরিয়া যুব তবলিগসহ অঙ্গসংগঠনের অনেকেই। এমনকি ভিন্নমত পোষণ করে আওয়ামী লীগের লোকজনও এলাকাছাড়া হয়েছেন। কোনো অপরাধেরই বিচার হতো না। এতকিছুর পরও কেউ তার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতে পারতেন না।
রাউজানে ফজলে করিম ও তার অনুসারীদের হাতে নির্যাতিত ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে ১৬ বছরের এই চিত্র পাওয়া গেছে।
জানা যায়, নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আওয়ামী লীগের বিরোধী কণ্ঠ হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করা ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) কর্মী ছিলেন ফজলে করিম। কাজ করেছেন দলটির ওই সময়কার প্রধান সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কর্মী হিসাবে। কিন্তু ১৯৯৪ সালে চাঁদাবাজি-ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে এনডিপির এসকান্দরসহ ৪০-৪৫ জন ক্যাডার নিয়ে দল থেকে হঠাৎ পদত্যাগ করেন ফজলে করিম। এর পরপরই তার আত্মীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সাবের হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে হাত করে রাতারাতি ঢুকে পড়েন রাউজান উপজেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে। ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে চাচাতো ভাই বিএনপি নেতা গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ৭ হাজার ৩২৯ ভোটে হারিয়ে চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সংসদ-সদস্য হন তিনি। চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তিনটিতে কোনো ভোটই হয়নি। তার এই এককাধিপত্য তাকে ভয়ংকর করে তোলে। নিজেকে নিয়ে মন্তব্যের মধ্যেই তার ভয়ংকর হয়ে ওঠার চিত্র স্পষ্ট। তিনি বলতেন, ‘বাঘে ধরলে বাঘে ছাড়ে; কিন্তু ফজলে করিম ধরলে ছাড়ে না।’
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের স্ত্রী সুমি আক্তার বলেন, ‘আমার সামনে থেকে স্বামীকে শহরের বাসা থেকে তুলে নিয়েছিল ফজলে করিমের ক্যাডাররা। শহর থেকে রাউজানে নিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে লাশ ফেলে রাখে। স্বামী খুন হয়ে গেল অথচ এর বিচার চেয়ে থানায় মামলাও করতে পারিনি। ঘটনার সাত বছর পর চকবাজার থানায় ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছি।
নুরুল হত্যা মামলার এজাহারে বলা হয়, ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ নগরের চকবাজার থানাধীন চন্দনপুরার পশ্চিম গলির মিন্নিমহল বাসায় রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ফজলে করিমের সরাসরি নির্দেশে রাউজান থানার তৎকালীন ওসি কেফায়েত উল্লাহর হুকুমে এসআই জাবেদ অফ-হোয়াইট কালারের টি-শার্ট পরিহিত অবস্থায় অস্ত্র হাতে এসে দরজায় নক করেন। তখন নুরুলের ভাগিনা রাশেদুল ইসলাম বাসার প্রধান দরজা খুলে দেন। এ সময় বাসায় ঘুমন্ত নুরুল আলমকে বিছানা থেকে টেনে তুলে হাতে হাতকড়া পরিয়ে দেন এসআই জাবেদ। তখন পরিবারের সদস্যদের পুলিশ জানায়, পরোয়ানামূলে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে পরিবারের সদস্যরা পরোয়ানা দেখতে চাইলে পুলিশ দেখায়নি। বাসার তিনটি মোবাইল ফোনসহ নুরুলকে বাইরে অপেক্ষমাণ একটি সাদা রঙের মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়। পরে তাকে নোয়াপাড়া কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কাপড় দিয়ে চোখ-মুখ বেঁধে ও রশি দিয়ে দুই হাত বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। পরে তার মাথায় গুলি করে হত্যার পর রাউজান বাগোয়ান ইউনিয়নের খেলারঘাট কর্ণফুলী নদীর তীরে লাশ ফেলে দেওয়া হয়। পরদিন ৩০ মার্চ লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩১ মার্চ ময়নাতদন্ত শেষে লাশ দাফন করা হয়। ঘটনার সময় দুটি মাইক্রোবাস ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে একটি গাড়ির চালক হেলাল বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাউজানের ১৪ নম্বর বাগোয়ান ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু জাফর অপহরণ ও গুমের নেপথ্যেও ছিলেন ফজলে করিম। ২৯ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে আবু জাফরের ছেলে জিসানুর রহমান অভিযোগ করেন, র্যাবের ইন্টেলিজেন্ট উইংয়ের প্রধান থাকাকালে মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান তার অধীন র্যাব-৭-এর সিও লে. কর্নেল হাসিনুরকে আদেশ করেন তার বাবাকে তুলে নিয়ে হত্যা করার জন্য। সেই আদেশ অমান্য করায় হাসিনুরকে র্যাব থেকে বদলি করে দেওয়া হয়। পরে জিয়াউল আহসান অন্য টিম দিয়ে তার বাবাকে তুলে নিয়ে গুম করেন। এখনো তার বাবার কোনো সন্ধান মেলেনি।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহসভাপতি সাবের সুলতান কাজল জানান, তার বিরুদ্ধে ৫০টির অধিক মামলা দিয়েছিলেন ফজলে করিম। চট্টগ্রাম নগর থেকে শুরু করে জেলার এমন কোনো থানা নেই, যেখানে তার বিরুদ্ধে জামিনযোগ্য বা জামিন অযোগ্য মিথ্যা ধারার মামলা দেওয়া হয়নি। রাউজান যুবদলের অধিকাংশ নেতার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। মামলার কারণে বিগত ১৬ বছর তিনি এলাকায় যেতে পারেননি। তার অত্যাচারে হাজার হাজার নেতাকর্মী ঘরছাড়া ছিলেন বছরের পর বছর। তিনি বলেন, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম নুর ছাড়াও পৌরসভা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক জয়নাল আবেদীন হান্নান, উপজলা যুবদল নেতা আবুল হাশেমকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। প্রবাসফেরত যুবদল নেতা মুসাকেও দিনদুপুরে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদের ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফাহিম মোহাম্মদ রিয়াদ বলেন, ‘জন্মের পর থেকেই তিনি নিজ এলাকায় যেতে পারেননি। বাবা যুবদল করেন, তাই তাদের এলাকায় যাওয়ার অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা ছিল বলে তিনি বড় হয়ে জানতে পেরেছেন। পরিবার নিয়ে তারা একপ্রকার আত্মগোপনেই থাকতেন বলে জানান। তিনি বলেন, ‘আমার দাদি মারা গেছেন ২০২০ সালে, দাদা মারা গেছেন ২০২১ সালে। কিন্তু কোনো জানাজায়ই আমার বাবাসহ আমরা কেউ যেতে পারিনি। মা-বাবার কবরে আমার বাবা মাটি পর্যন্ত দিতে পারেননি। এমনকি যার হাত ধরে এবিএম ফজলে করিম রাজনীতি শুরু করেছিলেন, সেই সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও নিজ এলাকায় কবর দিতে বাধা প্রদান করেন ফজলে করিমের লালিত সন্ত্রাসীরা।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, আওয়ামী লীগের শেষ ১০ বছর স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। মাদ্রাসা-মসজিদ, স্কুল কমিটির নির্বাচন পর্যন্ত হয়নি। বিনা ভোটে তার পছন্দের লোকজনকেই তিনি প্রার্থী করে নির্বাচিত ঘোষণা করতেন। কেউ নির্বাচন করতে চাইলে তাকে ভোগ করতে হতো নানা শাস্তি। এমনকি একবার রাউজানের পৌর মেয়র হিসাবে নির্বাচিত হওয়া নিজ দলের কর্মী দেবাশীষ পালিত চেয়ারম্যানের চেয়ারে বসতে পারেননি। যেতে পারেননি এলাকায়। কারণ, তার অমতে নির্বাচিত করেছিলেন দেবাশীষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সিন্ডিকেট ও সিনেট সদস্য এবং মুনিরিয়া যুব তবলিগ কমিটি বাংলাদেশের মহাসচিব (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুরের বাড়ি দুই দফা ভাঙচুর করা হয়। সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর আত্মগোপনে চলে যান ফজলে করিম চৌধুরী। ১৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সিমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর সময় দুই সহযোগীসহ তাকে হাতেনাতে আটক করে বিজিবি। ৩২ মামলার আসামি হয়ে বর্তমানে চট্টগ্রাম কারাগারে রয়েছেন ফজলে করিম। ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ ও রাউজান থানা পুলিশ তার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে বেশকিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে। এর মধ্যে রয়েছে রিভলভার, পিস্তল, রাইফেল, শটগান, টিয়ার গ্যাস লঞ্চার, বিপুল পরিমাণ গুলি, একনলা বন্দুক ও বন্দুকের কার্তুজ, বিস্ফোরক দ্রব্য। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা করে রাউজান থানা পুলিশ।