আনিসুর রহমান- রাজশাহী
রাজশাহী মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (রামেবি) কিছু নিয়োগে বের হয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। অভিযোগ উঠেছে, বিধি লঙ্ঘন করে অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জাল সনদে চাকরি জানার পরও অনিয়ম-দুর্নীতি চাপা দিতে কাজ করেছেন সাবেক উপাচার্য ও কয়েকজন কর্মকর্তা। গণমাধ্যমে অনিয়মের সংবাদ প্রকাশিত হলে তদন্ত কমিটির সুপারিশও কাজে আসেনি ক্ষমতাসীনদের দাপটে।
এসব সুযোগ কাজে লাগিয়ে একজন জাল সনদে এবং চাকরিতে বিধি অনুযায়ী প্রত্যাশিত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও বহাল রয়েছেন অন্য এক কর্মকর্তা।
২০১৮ সালে শুরুর দিকে রামেবিতে চুক্তিভিক্তিক (অ্যাডহক) পিও-কাম-কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেন ইসমাইল হোসেন। সেখানে তিনি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির স্নাতক যে সনদ জমা দেন, সেটি জাল। তিনি মাত্র ছয় মাসের মাথায় আগের পদ থেকে অব্যাহতি নিয়ে লিয়াজোঁ ও প্রটোকল অফিসার পদে যোগ দেন অ্যাডহকে।
২০২৩ সালে একটি সূত্র থেকে ইসমাইলের সনদ জাল বলে অভিযোগ করা হয় রামেবি ও ইউজিসিতে। সেই প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
কমিটির প্রধান ছিলেন রামেবির কলেজ পরিদর্শক প্রফেসর মোসাদ্দেক হোসেন। সেই কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসমাইলের ব্যক্তিগত নথিতে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সনদটি জাল।
তবে তদন্ত কমিটি এ-ও বলে, তিনি টাইমস বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি নেন। এদিকে টাইমস বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সনদ গোপনে নথিতে যুক্ত করা হয়, অনুসন্ধানে সেটিও জাল বলে প্রমাণিত হয়েছে। শুধু সনদ বদলই নয়; পুলিশের ভেরিফিকেশন রিপোর্ট টেম্পারিং করে তথ্যও সংযুক্ত করা হয়। ২০২৩ সালে আবারও তাঁর সনদের সত্যতা যাচায়ে রামেবি স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে সনদটি যাচায়ের জন্য পত্র পাঠায়, ইউনিভার্সিটি এটিকে জাল সনদ মর্মে রিপোর্ট দেয়।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৩তম সিন্ডিকেট সভায় পুনঃ তদন্তের জন্য কমিটি গঠিত হয়, ১৪তম সিন্ডিকেটে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
কিন্তু কমিটি তদন্ত শেষ করতে না পারায় সে কমিটির প্রধান বিশ্বজিৎ চন্দ কমিটি থেকে অব্যাহতি চান। ১৪তম সিন্ডিকেটে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি পুনর্গঠিত হয় কনক কান্তি বড়ুয়াকে প্রধান করে। এই কমিটি ১৫তম সিন্ডিকেট সভায় তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করে। প্রতিবেদনে আগের তদন্ত নাকচ করে ইসমাইলের বিরুদ্ধে জাল সনদের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করে।
সুপারিশের আলোকে কমিটি গঠিত হয় তাঁর শাস্তি নির্ধারণের জন্য। এ কমিটিতে ছিলেন তিন সিন্ডিকেট সদস্য। তাঁরা হলেন রাজশাহীর সাবেক এমপি ওমর ফারুক চৌধুরী, আব্দুল ওয়াদুদ দারা ও সাংবাদিক তানজিমুল হক। অভিযোগ উঠেছে, এই তিনজন ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শুধু তাঁর বেতন দুই বছরের জন্য কমিয়ে লঘু শাস্তির সুপারিশ করেন।
এদিকে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে সেকশন অফিসার হিসেবে অ্যাডহক ভিত্তিতে রামেবিতে যোগ দেন জামাল উদ্দীন মণ্ডল। তিন মাসের ব্যবধানে তিনি উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির বিপরীতে সহকারী কলেজ পরিদর্শক পদে স্থায়ী নিয়োগের আবেদন করেন। এ পদের যোগ্যতা চাওয়া হয় চার বছরের স্নাতকসহ পাঁচ বছরের নবম গ্রেডে চাকরির অভিজ্ঞতা। কিন্তু তিনি চার বছরমেয়াদি কোনো শিক্ষা সনদ জমা দেননি। একই সঙ্গে নবম গ্রেডেরও কোনো চাকরির সনদ জমা দেননি। নিয়োগ কমিটি বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণ না হওয়ায় আবেদন করা পদে নিয়োগ দিতে না পারলেও তাঁকে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে।
তৃতীয় সিন্ডিকেট সভা জামালের এ নিয়োগ কমিটির সুপারিশ অনুমোদন করে। কিন্তু বিষয়টি যথাযথ হচ্ছে না মনে করে তৎকালীন উপাচার্য মাসুম হাবীব চতুর্থ সিন্ডিকেট সভায় উপস্থাপনের জন্য এজন্ডাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। জানতে পেরে জামাল আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন। পরে জামাল আপিল করেন। আপিল চলাকালীন রামেবি কর্তৃপক্ষ জামালকে জানায়, মামলা প্রত্যাহার করলে রামেবি তাঁকে সেকশন অফিসার পদে স্থায়ী নিয়োগ দেবে। সেই শর্তে জামাল উদ্দীন মামলাটি প্রত্যাহার করে নেন এবং রামেবি কর্তৃপক্ষ তাঁকে সেকশন অফিসার পদে ২০২৩-এ স্থায়ী নিয়োগ দেয়। এ সময় রামেবির উপাচার্য ছিলেন প্রফেসর ডা. মোস্তাক হোসেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের বক্তব্য নিতে কল করা হলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে তিনি ফোন কেটে বন্ধ করে দেন।
এদিকে ইসমাইল হোসেনকে তাঁর মুঠোফোনে বারবার কল করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।
জামাল উদ্দীন মণ্ডল বলেন, ‘আমার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতা রয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।’ রামেবির বর্তমান উপাচার্য ডা. মোহা. জাওয়াদুল হক বলেন, এসব বিষয়ে আগামী সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা হবে।