ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা শুরুর পর শুক্রবার ছিল প্রথম ছুটির দিন। তবে ছুটির দিনেও মেলায় তেমন ভিড় নেই। স্টল তৈরি ও সাজসজ্জার কাজ এখনো চলছে।
শুক্রবার দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজধানীর পূর্বাচলে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিশন সেন্টারে মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
বিক্রেতারা বলছেন, আরও কয়েকদিন পর মেলা ধীরে-ধীরে জমে উঠবে।
দিনভর একেবারই জনসমাগম না থালেও বিকালের দিকে অল্প স্বল্প ক্রেতা-দর্শনার্থী মেলায় আসেন। তাদের বেশিরভাগই ঘুরি-ফিরে দেখেছেন। কেউ-কেউ তুলছেন ছবি।
বিক্রেতার বলছেন, কেনাকাটাও এখন অত বেশি না।
মেলায় নিত্যপ্রয়োজনীয় গৃহস্থালি পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন শেরপুর থেকে আসা শাহেদ হোসেন।
বলেন, “মেলা তো শুরুই হল দুদিন হয়েছে। আজ প্রথম ছুটির দিনেও অত ভিড় নেই। আবহাওয়াটা ভালো না, এটা একটা কারণ।
“তবে, গত দুই দিনের চেয়ে আজ লোকসমাগম কিছুটা বেশি। আর প্রতিবারই তো আসলে কয়েকদিন পর মেলা জমে ওঠে। এবারও সেরকমই হবে আমার মনে হয়।”
মেলায় অংশ নেওয়া ক্রোকারিজ দোকান ‘নিক্কেই জাপান’-এর বিক্রয়কর্মী শরিফুল ইসলাম বলেন, “কেনাকাটা এখনও খুব আহামরি না। ক্রেতারা আসছেন, ঘুরেফিরে দেখছেন। আরও কয়েকদিন পর হয়ত বিক্রয় বাড়বে।”
নরসিংদীর মাধবদী থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেলায় ঘুরতে এসেছিলেন মুহাম্মদ হাসনাত আলম বলেন, “পরিবার নিয়ে এলাম আজ প্রথম দিনে। কিছুই কিনিনি। আজ মূলত দেখতে এলাম, কেমন জমেছে। পুরোপুরি জমজমাট হয়ে ওঠেনি এখনও।”
রাজধানীর কুড়িল এলাকা থেকে মেলায় এসেছিলেন বেসরকারি চাকুরে মো. ওমর ফারুক। তিনি বলেন, “মেলায় ঘুরতে এলাম। ভালোই লাগছে। তবে, এখনও পুরোপুরি জমেনি। আবার আসব পরিবার নিয়ে।”
দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করছে বাংলাদেশ। এরপর ২০২২ সালে মেলার ভেন্যু রাজধানীর আগারগাঁও থেকে নিয়ে যাওয়া হয় পূর্বাচলে। এ বছর বসেছে এই মেলার ২৯তম আসর।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবারের মেলার যৌথ আয়োজক। এবারের মেলার বর্ষপণ্য ‘আসবাব’।
রীতি অনুযায়ী ইংরেজি নতুন বছরের প্রথম দিন-বুধবার থেকেই মেলা শুরু হয়েছে। মেলার উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
দেশে পণ্য প্রদর্শনীর সবচেয়ে বড় এ মেলায় এবার ৩৬২টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫১টিই দেশীয় প্রতিষ্ঠানের। বাকি ১১টি স্টল সাতটি দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের।
মেলায় অংশ নেওয়া সাতটি দেশ হল- ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক, সিঙ্গাপুর, ইন্দোনেশিয়া, হংকং ও মালয়েশিয়া।
মেলায় দেশীয় বস্ত্র, মেশিনারিজ, কার্পেট, কসমেটিক্স এ্যান্ড বিউটি এইডস, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক্সস, আসবাব, পাট ও পাটজাত পণ্য, গৃহসামগ্রী, চামড়া, কৃত্রিম চামড়ার জুতাসহ চামড়াজাত পণ্য, ক্রীড়াসামগ্রী, স্যানিটারিওয়্যার, খেলনা, মনিহারী পণ্য, ক্রোকারিজ, প্লাস্টিক, মেলামাইন পলিমার, হারবাল, টয়লেট্রিজ, ইমিটেশন জুয়েলারি, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, ফাস্টফুড, হস্তশিল্পজাত পণ্য, গৃহসজ্জার পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য মেলায় বিক্রির জন্য রাখা হয়েছে।
এখনও চলছে স্টল তৈরির কাজ
সাধারণত বাণিজ্য মেলার প্রথম কয়েকদিন ধরে স্টল তৈরি, সাজসজ্জা নিয়ে বিক্রেতাদের ব্যস্ততা থাকে বেশি। এবারও সেই চিত্র দেখা গেছে।
মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, স্টল তৈরি ঘিরে চলছে হাতুড়ি-বাটাল নিয়ে কাঠমিস্ত্রীদের ব্যস্ততা।
মেলায় স্টল নির্মাণের কাজ করছিলেন শ্রীকান্ত সূত্রধর। তিনি বলেন, “আমার সঙ্গে আরও ছয়জন কাজ করছেন। স্টলের আকৃতি আর ডিজাইন ভেদে ৫০ হাজার থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকি।”
আরেক মিস্ত্রি জাকির হোসেন বলেন, “আমরা এবার প্রায় ২০টির মতো স্টল তৈরি করেছি। চুক্তিতে আমরা এই কাজ করে থাকি। আমার সঙ্গে আরও পাঁচজন এই কাজে যুক্ত আছেন।”
অভ্যুত্থানে শহীদদের স্মরণে ‘জুলাই চত্বর’-‘ছত্রিশ চত্বর’
২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় যুগের শাসনের অবসান হয় গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
অভ্যুত্থানের শহীদদের স্মরণে এবারের মেলায় স্থাপন করা হয়েছে ‘জুলাই চত্বর’ এবং ‘ছত্রিশ চত্বর’।
এক্সিবিশন সেন্টারের দক্ষিণ-পূর্ব পাশে ‘জুলাই চত্বর’ আর উত্তর-পশ্চিম পাশে স্থান পেয়েছে ‘ছত্রিশ চত্বর’।
সেখানে অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া রংপুরের আবু সাঈদের ছবি স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি এবং অভ্যুত্থানের ইতিহাস নিয়ে লেখাও স্থান পেয়েছে।
যাতায়াতের জন্য রয়েছে বাসের ব্যবস্থা
গেল বারের ধারাবাহিকতায় মেলায় আসা-যাওয়ার জন্য বিআরটিসির ডেডিকেটেড বাস সার্ভিসের পাশাপাশি বিশেষ ছাড়ে এবার উবার সার্ভিসও চালু করা হয়েছে।
দর্শনার্থীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড, ফার্মগেট (খেজুর বাগান/খামার বাড়ী), নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদী হতে প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বাণিজ্য মেলার উদ্দেশ্যে বিআরটিসির ২০০টির বেশি ডেডিকেটেড শাটল বাস চলবে এবং মেলা প্রাঙ্গণ থেকে শেষ বাসটি ছাড়বে রাত ১১টায়।
ফার্মগেট (খেজুর বাগান/খামার বাড়ি) থেকে মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ৭০ টাকা; কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ৩৫ টাকা; নারায়ণগঞ্জ-মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ১২০ টাকা; নরসিংদী-মেলা প্রাঙ্গণ ভাড়া ৯০ টাকা; মেলা প্রাঙ্গণ থেকে গুলিস্তান ভাড়া ৮০ টাকা এবং গুলিস্থান থেকে নারায়ণগঞ্জ ভাড়া- ৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
দুয়ার খুলল বাণিজ্য মেলা: ২০২৫ সালের বর্ষপণ্য আসবাব
এবারের মেলার প্রাপ্তবয়স্কদের প্রবেশ টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ৫০ টাকা এবং ১২ বছরের নিচের শিশুদের জন্য ২৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রতিবন্ধীরা তাদের কার্ড প্রদর্শন করে বিনামূল্যে মেলায় প্রবেশ করতে পারবেন।
মেলার সার্বিক নিরাপত্তা এবং দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মেলা প্রাঙ্গণে পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশ, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, র্যাব, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত রয়েছে।
এছাড়া, মেলার নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রাঙ্গণের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান, প্রবেশ গেইট, পার্কিং এরিয়া এবং সংশ্লিষ্ট সব এলাকায় ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
আর, খাদ্য দ্রব্যের মান নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যসহ গঠিত টিম মেলা চলাকালীন প্রতিদিন ভেজাল বিরোধী ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছে।
মেলায় আসা দর্শনার্থীদের জন্য চিকিৎসকও রাখা হয়েছে।
এছাড়া মেলার থাকছে পর্যাপ্ত কার পার্কিংয়ের সুবিধা। পাঁচ শতাধিক গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা দ্বিতল কার পার্কিং বিল্ডিং ছাড়াও এক্সিবিশন হলের বাইরে ৬ একর জমিতে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
মেলার সার্বিক কার্যক্রম মনিটরিংয়ের জন্য মেলা প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ এবং তথ্য কেন্দ্র। ব্যাংকিং সার্ভিসের জন্য মেলায় পর্যাপ্ত সংখ্যক ব্যাংক বুথও রয়েছে।
এছাড়া মা ও শিশুদের জন্য মেলায় রাখা হয়েছে মা ও শিশু কেন্দ্র। দর্শনার্থী ও বয়স্কদের জন্য সিটিং কর্নারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মাসব্যাপী মেলাটি প্রতিদিন সকাল ১০টায় শুরু হয়ে চলবে রাত ৯টা পর্যন্ত; আর সাপ্তাহিক ছুটির দিনে মেলা চলবে রাত ১০টা পর্যন্ত।